নিজস্ব প্রতিবেদক:
আলীরটেক ২নং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী শাহাজাদী। এই শিক্ষার্থীকে সপ্তাহ খানেক ধরেই স্কুলে যেতে দিচ্ছে না অভিভাবকরা। ছেলে ধরা গুজবের আতঙ্ক থেকেই স্কুলের যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শাহজাদীর মতো অনেক শিক্ষার্থীর। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে মানুষের কাটা মাথা লাগবে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন যাবৎ গুজব ছড়াচ্ছে একটি কুচক্রি মহল। আর এই প্রচারণাকে কুচক্রী মহলের গুজব বলে জানিয়েছে সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। অভিভাবকদের দাবী, নারায়ণগঞ্জেও বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনদের আটক করা হয়েছে। আহত থেকে নিহতের ঘটনাও ঘটে গেছে অল্প কিছুদিনের মধ্যে। যার কারণেই স্কুলে সন্তানদের পাঠাতে ভয় পাচ্ছে অভিভাবকরা।
তবে এই বিষয়টি পুরোপুরি মিথ্যা ও কান না দেওয়ার আহবান জানিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম এই গুজবের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এক চিঠিতে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ পরিচালনায় মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি কুচক্রী মহল বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা প্রকল্প কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। যা পুরোপুরি মিথ্যা।
জানা যায়, গত ১০জুলাই ছেলে ধরা সন্দেহে বাবাকে আটক করেন সাধারণ জনগন। নগরীর ব্যস্ততম সড়ক দুই নম্বর রেল গেইট এলাকায়, তিন শিশুকে বকাঝকা করে রিকশায় নিয়ে যাচ্ছেন এক যুবক। বাচ্চাদের কান্না দেখে সন্দেহ হয় সাধারণ জনগণের। রিকশা থামিয়ে ভিড় জমায় আশেপাশের লোকজন। এক পর্যায়ে শিশু অপহরণকারী ভেবে যুবককে গণপিটুনি দেয় তারা। পরবর্তীতে জানা যায়, সেই যুবকটি বাচ্চাদের বাবা।
পরদিন ১১জুলাই একই গুজবের কারনে সোনারগাঁয়ে গনপিটুনীর শিকার হয় এক মানুষিক ভারসাম্যহীন নারী। সোনারগাঁয়ের শম্ভুপুরা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
সর্বশেষ ২০জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জে মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যবধানে দুই সন্দেহভাজনকে গনপিটুনী দেয় স্থানীয়রা। এতে অজ্ঞাত এক যুবক নিহত হয়। এবং উদ্ধার করা হয় সাদিয়া নামের এক স্কুল ছাত্রীকে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকাল সাড়ে ৮টায় আলামিন নগরের আইডিয়াল ইসলামিক স্কুলের শিশু শ্রেণির ছাত্রি সাদিয়া (৬) স্কুলে যাওয়ার পথে অজ্ঞাত ওই যুবক কোলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার শুরু করে। এলাকাবাসী ছেলে ধরা সন্দেহে অজ্ঞাত যুবককে গণপিটুনি দেয় এবং সাদিয়াকে উদ্ধার করে। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় যুবককে উদ্ধার করে শহরের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালে পাঠায়। পরে সেখানকার জরুরী বিভাগের ডাক্তার যুবককে মৃত ঘোষণা করেন।
অপরদিকে, ছেলে ধরা সন্দেহে শারমিন (২০) নামে এক নারীকে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে। পরে পুলিশ তাকে আটক দেখিয়ে চিকিৎসার জন্য গুরুত্বর আহত অবস্থায় শহরের খানপুর ৩শ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করে। পরবর্তীতে খোজ নিয়ে জানা যায়, গনপিটুনির শিকার নারীটি মানসিক রোগী।
কাউকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পুলিশ দপ্তরের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে এই আহ্বান জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্র বিরোধী কাজের সামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারী অপরাধ।
এদিকে গতকাল সকালে পরপর দুটি ছেলেধরার ‘গুজব’ তুলে ধরে একজন নারী ও একজন যুবককে গণধোলাই দেয় জনতা। এরমধ্যে প্রথম ঘটনাটি ঘটে সিদ্ধিরগঞ্জের আলামিন নগরে। এখানে সকাল আটটার দিকে হঠাৎ করেই গুজব ছড়িয়ে পরে রাজমিস্ত্রী সোহেলের মেয়ে এবং আইডিয়াল কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষার্থী সাদিয়া (৭) কে কেউ একজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এমন খবরে এলাকাবাসী জড়ো হয়ে সন্দেহভাজন এক যুবককে গণধোলাই দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ওই যুবককে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে শহরের খানপুর হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোসণা করেন।
থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাখাওয়াত জানান, যে মেয়েটিকে ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো বলে গুজব রটেছিলো, পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ওই মেয়েটি তার স্কুলে ক্লাস করছে। পুরো বিষয়টিই গুজব বলে ধারণা করছি।
অপরদিকে এই ঘটনার ২ ঘণ্টা না পেরুতেই সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লা শাপলা চত্বর এলাকার বিল্লালের বাড়ির ভাড়াটিয়ার সন্তানকে পুতুল দেখিয়ে ধরে নেওয়া গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এসময় এলাকাবাসী ওই বাড়ির চারতলায় গিয়ে সন্দেহভাজন তরুণী শারমীনকে আটক করে নিয়ে আসে এবং গণধোলাই দেয়। খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তরুণীকে উদ্ধার করতে গেলে উত্তেজিত জনতা পুলিশের উপরও চড়াও হয়। এসময় স্থানীয়রা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট ও জুতা ছুড়ে মারে। এ ঘটনায় পুলিশের সাথে এলাকাবাসীর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এদিকে এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলা হয়। তাদের অনেকেই জানান শিশুটি ধরে নেয়ার দৃশ্যটি তারা দেখেছেন। তাদের সামনেই রাস্তায়র উপর এ ঘটনা ঘটে। ছেলেধরা নারীটি শিশুটিকে একটি পুতুল দেখিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে শিশুটি চিৎকার করলে এলাকাবাসী এসে জড়ো হয় এবং তাকে মারধর করে। কিন্তু মূল ঘটনার সাথে এর কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
গণমাধ্যমকর্মীরা ঘটনার মূলে যেতে শিশুটির খোঁজ করা শুরু করে। পরে জানা যায় বিল্লালের বাড়ির চারতলাতে এই ঘটনার সূত্রপাত। চারতলায় গিয়ে কথা হয় যাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ‘গুজব’ ছড়িয়েছে সেই ফাইজুল ইসলাম লাবিবের নানী খাদিজা আক্তারের সাথে।
তিনি জানান, হঠাৎ করে কর্নিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলি। সঙ্গে সঙ্গেই একজন মেয়ে কথাবার্তা ছাড়াই ভেতরে ঢুকে সোজা খাটের উপরে বসে পড়ে। তার কাছে জানতে চাই সে কে, কাকে চায়। উত্তরে সে জানায়, এই ফ্যালাটে তারা আগে থেকেছে। কিন্তু এই ফ্ল্যাট হওয়ার পর একমাত্র ভাড়াটিয়া আমরাই। এরমধ্যে সে তার ব্যাগ থেকে পুতুল বের করে। তখন কেমন যেন একটা গন্ধ বের হয়।
পরে তার কথাবার্তা আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে আমার অনার্স পড়ুয়া মেয়ে বাড়িওয়ালাকে ফোন করলে এলাকাবাসী এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়।
এছাড়াও এর আগেরদিন শুক্রবার সকালে একইরকম ঘটনা ঘটে সিদ্ধিরগঞ্জের ৮ নং ওয়ার্ডে। এখানে এলাকাবাসী এক নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে আটক করে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে ওই নারীর ব্যাগ থেকে চাকু, ব্লেড পাওয়া গেছে। সে গলাকাটা দলের সদস্য। এতে উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধরা ওই নারীকে গণধোলাই দেয়। পরে খবর পেয়ে কাউন্সিলর রুহুল আমিন মোল্লা ওই নারীকে উদ্ধার করে এবং পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে ওই নারীকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
রুহুল আমিন মোল্লা জানান, সবাই দাবি করছিলে ওই মহিলার কাছে ব্লেড, চাকু পাওয়া গেছে। আদতে তেমন কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। কেউ সে প্রমাণও দিতে পারেনি। আমি হয়তো আরেকটু দেরী করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে বিক্ষুব্ধ মানুষ ওই মহিলাকে মেরেই ফেলতো। পরে উত্তেজিত মানুষের ¯্রােত সামলাতে না পেরে থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পুরো ঘটনাটিই গুজব বলে মনে হয়েছে।